ঝিনাইদহের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের কথা

ঝিনাইদহের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের কথা (ছবিঃ সংগ্রীহিত)

ঝিনাইদহ জেলা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বিশেষ গুরূত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। বাঙালী জাতির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন হলো-আমাদের স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালে এ জেলার অধিবাসীগণ বারুদের স্ত্তুপের মতো একযোগে বিস্ফোরিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিশিখা জেলেছিল রণাঙ্গনে, শহরে-বন্দরে, গ্রাম-গঞ্জে। তদানীন্তন পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দল আওয়ামীলীগের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন এই মর্মে রেসকোর্স ময়দানে ‘‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’’ এবং ‘‘ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল’’ বলে আহবান জানালেন তখন ঝিনাইদহেও অবরোধ প্রস্ত্ততি ব্যাপকভাবে শুরু হয় এবং গঠিত হয় সংগ্রাম পরিষদ। এই সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক ছিলেন জে কে এম এ আজিজ, মাননীয় এম,সি,এ, জনাব মাইনুদ্দিন মিয়াজী, মাননীয় এম,সি,এ, (সদস্য), এ বি এম গোলাম মজিদ, মাননীয় এম,সি,এ, (সদস্য), কাজী খাদেমূল ইসলাম(সদস্য), নূরুন্নবী সিদ্দিকী(সদস্য), এহিয়া মোল্লা(সদস্য), জনাব আব্দুল গফুর(শহীদ সদস্য), জনাব তাইজুদ্দিন(সদস্য),জনাব সিরাজুল হক(সদস্য), জনাব সিরাজুল ইসলাম(সদস্য) প্রমূখ।
বিষয়খালী যুদ্ধ
১লা এপ্রিল, ১৯৭১ বৃহস্পতিবার দুপুর সাড়ে বারোটায় হঠাৎ খবর আসলো হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর বিষয়খালী আক্রমণের। তড়িৎ গতিতে মুক্তিবাহিনী প্রধান মাহবুব সাহেব প্রতিরোধ বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হলেন বিষয়খালী অভিমুখে। উভয় পক্ষে সামনা সামনি যুদ্ধ হলো। এটাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম সমর। ভীষণ যুদ্ধ হয়েছিল ঠিক দুপুর একটার সময়। আমাদের দেশের টগবগে তরুণরা অনভিজ্ঞ এবং তাদের ছিলনা ভারি কোন অস্ত্র, কিন্তু তাতে কি? মাতৃভূমির পবিত্রতা রক্ষা করতে তারা মরণকে হাসিমুখে বরণ করতে রাজী। কামানের গোলা ব্যর্থ হয়ে গেল তাদের অসীম সাহসের কাছে। হানাদার পাকিস্তানী বাহিনী অতিক্রম করতে পারলোনা বিষয়খালী নদী, তারা ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেল যশোর ক্যান্টনমেন্টে। বাংলাদেশের ইতিহাসে যুদ্ধ বিজয়ের গৌরবের প্রথম মাইল ফলক স্থাপন করল এই বিষয়খালীর যুদ্ধে। এই যুদ্ধের কাহিনী প্রথম বিদেশী রেডিও বিবিসি, ফরাসি বার্তা সংস্থা এবং অস্ট্রেলীয় রেডিও এবিসিতে প্রচারিত হয়।
গেরিলা আক্রমণঃ
ভারতে ট্রেনিং প্রাপ্ত ঝিনাইদহ জেলার নওজোয়ানরা মুক্তিবাহিনীর নির্দেশ মত নিজেদের ভিতরে এবং তাদের দোসর রাজাকারদের সমূলে বিনাশ করতে থাকে। এমন কয়েকটা প্রচন্ড গেরিলা যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল শৈলকুপা উপজেলায়। উল্লেখযোগ্যগুলি হচ্ছে (১) শৈলকুপা থানা আক্রমণ (২) কামান্নার যুদ্ধ(৩) আবাইপুর হাইস্কুল প্রাঙ্গনের যুদ্ধ (৪) আলফাপুরের যুদ্ধ। কামান্নার যুদ্ধে ২৭ জন এবং আবাইপুরে ১০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। কামান্নার মুক্তিযোদ্ধাদের নেতা নজরুল ইসলাম শহীদ হন। স্বাধীনতা অর্জিত হওয়ার পর কামান্নাতে নিহত ২৭ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্মরণে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে ঝিনাইদহ শহরে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। আলফাপুরে নেতৃত্ব দেন শৈলকুপা থানা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী প্রধান মন্টু, আবু আহমেদ, সোনা মোল্লা এবং শ্রীপুরে আকবর চেয়ারম্যান। হানাদারপাকিস্তানী বাহিনীর ২ জন ক্যাপ্টেন, ৩ জন সিপাহী এবং ৪ জন রাজাকার নিহত হয়। গেরিলাদের কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। শহরের এবং গ্রাম-গঞ্জের অধিকাংশ লোক গেরিলাদের সর্বতোভাবে সহায়তা করে স্বাধীনতা ত্বরান্বিত করে তোলো।

প্রত্যক্ষ ও সম্মখ সমরঃ
১৯৭১ এর নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে একদিকে গেরিলাযুদ্ধ চরম আকার ধারণ করে অপর দিকে ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তি বাহিনী যৌথভাবে (মিত্রবাহিনী) সীমান্ত অতিক্রম করে ভিতরে ঢুকে পড়ে এবং মুক্ত এলাকার সৃস্টি করে। ডিসেম্বরের ৩ /৪ তারিখে মহেশপুর, কোটচাঁদপুর এবং চুয়াডাঙ্গা এলাকা দিয়ে কপোতাক্ষ ও চিত্রানদী অতিক্রম করে ৫ও ৬ ডিসেম্বর ঝিনাইদহ পৌছে। মিত্র বাহিনীকে পাকিস্তানীহানাদার বাহিনী বাধা না দিয়ে ছত্রভংগ হয়ে পলায়ন করে। ৬ ডিসেম্বর ঝিনাইদহ শহর তথা জেলা হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্তি লাভ করে।
দলমত নির্বিশেষে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের ৭/৮ ডিসেম্বর হত্যা করার হানাদারদের নীলনক্সা বিফল হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই ঝিনাইদহ হল স্বাধীন। যে ঝিনাইদহ প্রথম সম্মুখ সমরে বিষয়খালীর যুদ্ধে জয়লাভ করে সেই ঝিনাইদহ-ই সমগ্র দেশের স্বাধীনতা লাভের আগে স্বাধীনতা লাভ করে।
প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা যাচাই তালিকা প্রণয়ন জাতীয় কমিটি কর্তৃক সর্বশেষ প্রকাশিত সরকারী গেজেট মোতাবেক উপজেলা ওয়ারী জেলার বীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা।
