বখাটেদের নির্মমতায় দুই পা হারানো বাবা কি ন্যায়বিচার পাবেন?
1 min read
অপরাধ নিজের মেয়েদের উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করেছিলেন তিনি। চাচাতো ভাইয়ের হত্যা মামলার প্রধান সাক্ষী হিসেবে আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। পাশাপাশি সামাজিকভাবে একপক্ষকে সমর্থন করেন তিনি। আর এতেই ক্ষিপ্ত হয় আরেকপক্ষ। বেছে নেয় হিংস্রতার পথ। যাদের বর্বরতা হার মানিয়েছে মধ্য যুগকেও।
ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার নলডাঙ্গা গ্রামের দিনমজুর শাহানুর বিশ্বাস। অন্যের বাড়িতে শ্রম বিক্রি ও কৃষিকাজ করে সংসার চালান তিনি। তবে, আর্থিক সমস্যা, অসামর্থ্যতা ও নিজে অশিক্ষিত হলেও দুই মেয়ে শারমীন আক্তার এবং শাহানাকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার অদম্য ইচ্ছা ছিল শাহানুরের। কিন্তু দুর্বৃত্তরা তার সেই ইচ্ছাকে অস্ত্রের কোপে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করেছে।
শাহানুর বর্তমানে ঢাকার শেরেবাংলা নগরের জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের তৃতীয় তলার বি ওয়ার্ডের জি-৬১ নম্বর বেডে (পঙ্গু হাসপাতাল) যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন।
গত ১৬ই অক্টোবর কালীগঞ্জের ওই গ্রামে সহিংসতার শিকার হন শাহানুর। সন্ত্রাসীরা তাকে নির্মমভাবে পেটায়। ধারালো অস্ত্র দিয়ে তার পা দুটি থেঁতলে দেয়। চিরতরে তাকে পঙ্গু করে দিতে লোহার রড দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে পা দুটি ক্ষতবিক্ষত করে। আঘাত মারাত্মক হওয়ায় তার পায়ে পচন ধরেছিল।
ইতিমধ্যে তার ডান পায়ের হাঁটুর নিচে কেটে ফেলতে হয়েছে। কাটতে হয়েছে বাম পাও। পঙ্গু হাসপাতালের চিকিৎসকরা বলছেন বাম পা হাঁটুর উপরে কাটা হলেও ক্ষতস্থানের পচন রোধ করা যাচ্ছে না। তাই ওই পায়ে আবারো অস্ত্রোপচার করে পায়ের যেটুকু বাকি আছে তাও কেটে বাদ দিতে হবে।
পঙ্গু হাসপাতালের বি ওয়ার্ডের ওই বেডে গিয়ে দেখা যায়, শাহানুর যাকেই দেখেন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। ঘটনার বীভৎসতায় মানসিকভাবেও কিছুটা বিপর্যস্ত তিনি। আবোল তাবোল ও অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছেন। শাহানুরের স্ত্রী, স্বজন, হাসপাতালের চিকিৎসক ও যারাই তাকে দেখছেন তারাই শিউরে উঠছেন।
কোনো মানুষ অন্য একজন মানুষকে এভাবে নৃশংস উন্মত্ততায় আঘাত করতে পারে-তা তারা ভেবে পাচ্ছেন না। তবে, অপরাধীরা প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক আশীর্বাদপুষ্ট, তাই তাদের বিচার হবে কি-না এমন সংশয়ে রয়েছেন শাহানুরের পরিবারের সদস্য ও স্বজনরা। আর বিচার যদি না হয় তাহলে আল্লাহর কাছে বিচারের ভার দিয়েছেন শাহানুর, তার স্ত্রী মোসাম্মৎ আরজিনা, দুই কন্যা ও স্বজনরা।
শাহানুর বিশ্বাস, তার স্বজন, প্রতিবেশী ও স্থানীয় পুলিশ জানায়, শুধু দুই মেয়েকে উত্ত্যক্ত করা প্রতিবাদের কারণই নয়, সেখানকার (কালীগঞ্জের নলডাঙ্গা গ্রাম) স্থানীয় রাজনীতি ও প্রভাবশালীদের সামাজিক দ্বন্দ্ব ও প্রতিহিংসার বলি হয়েছেন শাহানুর। একই সঙ্গে দুই মেয়েকে বখাটেদের উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করায় তার ওপর ক্ষিপ্ত ছিল এলাকার একটি মহল।
বড় মেয়ে শারমিন আক্তার স্নাতক শ্রেণিতে পড়ছেন। ছোট মেয়ে শাহানা স্থানীয় একটি স্কুলে পড়েন সপ্তম শ্রেণিতে। বাড়িতে আসা-যাওয়ার পথে প্রায়ই তাদের উত্ত্যক্ত করতো স্থানীয় বখাটে কামাল, জাহিদ, বিল্লালসহ বেশক’জন। উত্ত্যক্তের মাত্রা ছাড়িয়ে ছিল সীমানা। শাহানুর ও তার স্বজনরা জানান, স্থানীয় সন্ত্রাসী ও প্রভাবশালী সন্তোষ, ইসহাক, মাহবুব মেম্বারের ছেলে ও ঘনিষ্ঠজন ওই বখাটে সন্ত্রাসীরা। তাই ভয়ে এতদিন মুখ খোলেন নি নিরীহ শাহানুর। ভয়ে হাসপাতালে শুয়েও শান্তি পাচ্ছেন না তিনি।
শাহানুরের স্বজনরা জানান, গত ১৬ই অক্টোবর বখাটেরা আবারো উত্ত্যক্ত করে দুই মেয়েকে। এর প্রতিবাদ করেন শাহানুর। এরপরই নেমে আসে বর্বরতা। সন্ত্রাসী মোতালেব, কামাল, মাহবুব, জাহিদ, বিল্লাল, হাসানসহ আরো ক’জন ছুরি, চাপাতি, রড নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার ওপর। নির্মমভাবে পেটায় তাকে। থেঁতলে দেয় দুই পা। চিরদিনের মতো তাকে পঙ্গু করে দিতে রড দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দুই পা ক্ষতবিক্ষত করা হয় তার। মৃত ভেবে অকুস্থলেই ফেলে রেখে চলে যায় সন্ত্রাসীরা।
পরে শাহানুরকে ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তার অবস্থার অবনতি হলে তাকে নিয়ে আসা হয় ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে। বর্তমানে সেখানেই চিকিৎসা চলছে তার। তবে, আর কোনোদিন তিনি স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবেন না বলে চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে জানান তার স্ত্রী।
এদিকে শাহানুরকে ক্ষতবিক্ষত করার পর স্থানীয় থানায় মামলা দায়ের করতে গেলে প্রভাবশালীদের চাপে পুলিশ মামলা নেয়নি বলে অভিযোগ করেন শাহানুর ও তার প্রতিবেশীরা। পরে ঝিনাইদহ আমলি আদালতে কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে মামলা করা হয়। কিন্তু মামলার আসামিরা গ্রেপ্তার না হওয়ায় ভয় ও আতঙ্কে রয়েছেন তারা। জানা গেছে, হুমকিসহ প্রতিনিয়ত মামলা তুলে নেয়ার চাপ রয়েছে ওই পরিবারটির ওপর।
পঙ্গু হাসপাতালে শাহানূরকে দেখতে আসা তার প্রতিবেশী রওশন আলী রাজু বলেন, স্থানীয় রাজনীতি, প্রভাবশালীদের সামাজিক দ্বন্দ্ব ও চাচাতো ভাই রবি হত্যা মামলায় সাক্ষ্য দেয়ায় বলি হয়েছেন নিরীহ শাহানুর। একই সঙ্গে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা ও বখাটেপনার প্রতিবাদ করা ছিল তার অপরাধ। এ কারণেই তাকে এমন নির্মমভাবে আঘাত করা হয়েছে। এভাবে কোনো মানুষ অন্য আরেকজনকে আঘাত করতে পারে না। তিনি বলেন, সন্ত্রাসীরা প্রভাবশালী, তাই ঘটনার পর থেকেই নানা হুমকি ও ভয়ভীতির মধ্যে এই পরিবারটি আতঙ্কে দিন পার করছে।
শাহানুরের স্থানীয় ভাইপো পীর আলী বলেন, মূলত দুই মেয়েকে উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করাতেই তাকে (শাহানুর) পঙ্গু করে দেয়া হলো। সন্ত্রাসীরা শুধু তাকে চিরদিনের জন্য পঙ্গুই করেনি, এখন পরিবারের বাকি সদস্যদেরও পা ভেঙে দিয়ে পঙ্গু করে দেবে-এমন হুমকি দিচ্ছে তারা।
এদিকে আসামিরা গ্রেপ্তার না হওয়া, মামলার ভবিষ্যৎ ও পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত শাহানুর। পঙ্গু হাসপাতালে কান্নাজড়িত কণ্ঠে শাহানুর বিশ্বাস বলেন, আমার কি অপরাধ? কেন আমাকে সারাজীবনের জন্য পঙ্গু করে দিলো ওরা। তিনি বলেন, এখনো প্রতিনিয়ত হুমকি দেয়া হচ্ছে। আমার অর্থ সম্পদ কিছুই নেই। আমি কি সুষ্ঠু বিচার পাবো?
চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে শাহনুরের স্ত্রী আরজিনা কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, তারা (চিকিৎসকরা) অনেক চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কিছুতেই দু’পা রাখা সম্ভব হয়নি। এখন তারা বলছেন, বাম পায়ে আবারো পচন ধরেছে। তাই ওই পায়ের যেটুকু আছে তাও কেটে বাদ দিতে হবে।
তিনি বলেন, এই দুনিয়ায় এর বিচার না হলেও আল্লাহর দুনিয়ায় এর বিচার হবে।
আসামিদের গ্রেপ্তার ও মামলার সর্বশেষ অবস্থার বিষয়ে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ থানার ওসি (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, মূলত এখানকার সামাজিক দ্বন্দ্বের জেরে আক্রমণের শিকার হয়েছেন শাহানুর বিশ্বাস। ঘটনার পরপরই আমি মামলা করার জন্য তাদের ডেকেছিলাম। কিন্তু তারা আসেনি। পরে ৬ই নভেম্বর আদালতের আদেশে বিষয়টি তদন্তের দায়িত্ব পাই। আর ওই দিনই শাহানুরের ভগ্নিপতি ১৬ জনকে আসামি করে থানায় মামলা দায়ের করে। ইতিমধ্যে দুইজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারের ভয়ে বাকি আসামিরা গা-ঢাকা দিয়েছে। তবে, অচিরেই তাদের গ্রেপ্তার করা হবে।