ওসি মোয়াজ্জেমের আদি বাড়ি ঝিনাইদহে
1 min readঝিনাইদহ নিউজ: ফেনীর সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের বাড়ি যশোরে। শহরের চাঁচড়া ডালমিল এলাকায় যৌথ পরিবারে বসবাস। ওয়ারেন্ট জারির পর থেকে পরিবারের সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ নেই বলে দাবি করেছেন মা মনোয়ারা বেগম ও ভাই আরিফুজ্জামান খন্দকার। যদিও স্ত্রী ও সন্তান কুমিল্লায় বসবাস করেন।
মঙ্গলবার সকালে ওসি মোয়াজ্জেমের বাড়িতে স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দ্বিতল বাড়িটিতে ছোট দুই ভাই ও একমাত্র বিবাহিত বোন বর্তমানে মায়ের সঙ্গে এখানে থাকছেন। মোয়াজ্জেমের স্ত্রী-সন্তান কেউ থাকেন না।
ওসি মোয়াজ্জেমের বাবার নাম খন্দকার আনসার আলী। পাঁচ ভাই এক বোনের মধ্যে তিনি বড়। তার এক ভাই সৌদি আরব ও আরেক ভাই আমেরিকা প্রবাসী। তাদের আদি বাড়ি ঝিনাইদহ সদর উপজেলার বৈডাঙ্গা গ্রামে। বাবার চাকরি সুবাদে তারা দীর্ঘদিন ধরে যশোর শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। মোয়াজ্জেম এই বাড়িতে থেকেই শিক্ষাজীবন শেষ করেছেন। তবে চাকরিতে প্রবেশের পর বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ কমে গেছে তার।
১৯৯৭ সালে উপপরিদর্শক পদে পুলিশে যোগদান করেন মোয়াজ্জেম হোসেন। ২০১০ সালের দিকে পরিদর্শক পদে পদোন্নতি পান। প্রায় দেড় বছর সোনাগাজী থানায় ওসির দায়িত্ব পালন করেছেন।
ওসি মোয়াজ্জেমের তৃতীয় ভাইয়ের স্ত্রী রেকসোনা খাতুন জানান, মাস ছয়েক আগে বাবার মৃত্যুবার্ষিকীর পর আর বাড়িতে আসেননি মোয়াজ্জেম। তার শ্বশুরের আদি বাড়ি ঝিনাইদহে। যশোর সদরের পুলেরহাটেও একটি বাড়ি আছে তাদের। তবে সেটা ভাড়া দেওয়া হয়েছে।
ওসি মোয়াজ্জেম কোথায়, জানে না পরিবারও: ওসি মোয়াজ্জেমের মা মনোয়ারা বেগম বলেন, আমার ছেলে জীবনে কোনো অন্যায় কাজ করেননি। তাকে ফাঁসানো হয়েছে। আমার ছেলে নিরাপদে ফিরে আসুক, এটিই আমার দাবি। নুসরাত হত্যার বিচার হোক। দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক। আমার ছেলের জন্যই নুসরাত হত্যাকারীদের ধরা পড়েছে।
ওসি মোয়াজ্জেমের ভাই আরিফুজ্জামান খন্দকার বলেন, গত ২৬ মে ওয়ারেন্ট জারির পর আর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি ভাই। আগে নিয়মিত কথা হতো। এখন কোথায় আছেন, কেমন আছেন- জানি না।
তিনি বলেন, নুসরাত হত্যার মূল মামলা বাদ দিয়ে ভাইয়ের বিরুদ্ধে করা সাইবার ক্রাইম মামলা নিয়ে বেশি তোড়জোড় শুরু হয়েছে। মূল আসামিদের অনেকেই এখনও গ্রেফতার হয়নি।
ভাই আরিফুজ্জামান খন্দকার বলেন, নুসরাতের যে ভিডিওটা ভাইরাল হয়েছে, সেটি ভাই প্রকাশ করেনি। অন্য একজন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছেড়েছে।
এই অপরাধে সাইবার ক্রাইমের মামলা দেয়া হয়েছে। অথচ ওই ভিডিওটিই নুসরাতের দেয়া বড় ডকুমেন্ট। যার ভিত্তিতে ভাই অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলাকে গ্রেফতার করেছিল। যার জন্য ভাইকে পুরস্কৃত করা উচিত ছিল। সেটি না করে উল্টো মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, এলাকার মানুষের কাছে খোঁজ নেন, আমার ভাইয়ের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। কর্মজীবনেও কোনো অপরাধের তথ্য নেই। সাধারণ জীবনযাপন করেন। এ ঘটনার পর নানারকম কথা শুনতে হচ্ছে।
তবে ওসি মোয়াজ্জেমের ছোট ভাইয়ের স্ত্রী উম্মেহানি দাবি করেন, নুসরাতের শ্লীলতাহানির ঘটনায় জড়িতদের আটক করা সহজ ছিল না। ভাই সেটি করতে পেরেছিলেন নুসরাতে বক্তব্যের ভিডিওর ভিত্তিতে।
আমাদের ধারণা, তিনি সেফটি ডকুমেন্ট হিসেবে ভিডিওটি ধারণ করেছিলেন। তবে তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করেননি। টেবিলের ওপর ফোন রেখে বাথরুমে গিয়েছিলেন। এই ফাঁকে তার মোবাইল থেকে ভিডিওটি হস্তান্তর হয়েছিল।
অভিযোগ রয়েছে, সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত ইভটিজিংয়ের শিকার হয়ে বিচার প্রত্যাশায় স্থানীয় থানায় গেলে সহযোগিতার বদলে সে ঘটনা ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করে তাকে হয়রানি করেন ওসি মোয়াজ্জেম। তখন তিনি কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়ায় আসামিরা আরও সাহসী হয়ে নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে তাকে পুড়িয়ে হত্যা করে।
যে অপরাধে ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে মামলা: অগ্নিদগ্ধ নুসরাত যখন চিকিৎসাধীন ছিলেন, তখনও আসামিদের গ্রেফতার না করে মামলা দায়ের বিলম্বিত করার চেষ্টার অভিযোগ রয়েছে ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে।
১০ এপ্রিল নুসরাতের মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রী এ ঘটনায় কোনো আসামি ছাড় পাবে না ঘোষণা দিলে ওসি মোয়াজ্জেমের ভিডিও ছড়ানোর অভিযোগ সামনে চলে আসে। এর পর গত ১৫ এপ্রিল সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন বাদী হয়ে তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলা করেন।
ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের পর আদালতে মামলার বাদী তার জবানবন্দিতে বলেন, ‘নুসরাত হত্যাকাণ্ড বর্তমান সময়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ্দৌলার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেন ওই মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি। একই অভিযোগে গত ২৭ মার্চ নুসরাতের মা ওই অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। ওই দিনই সিরাজ উদ্দৌলাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এ ঘটনার পর নুসরাতকে থানায় ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এ সময় ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন নুসরাতকে জেরা করাসহ তা ভিডিওতে ধারণ করেন। পরে ওই ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়, যা সারাবিশ্বের মানুষ দেখেছে। যদি নুসরাত বেঁচে থাকতেন, তাহলে এরকম ঘটনার পর তার বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে যেতো। থানার একজন ওসির রুমে একজন ভিকটিমকে এভাবে জেরা করা ও ভিডিও ধারণ করে সম্প্রচার করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অপরাধ।’
ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত। একপর্যায়ে ফেনীর সোনাগাজী থানা থেকে তাকে প্রত্যাহার করে সাময়িক বরখাস্ত করা হয় এবং রংপুর রেঞ্জে তাকে সংযুক্ত করা হয়।
রংপুর রেঞ্জে যোগ দিলেও ঈদের পর তাকে আর খুঁজে পাচ্ছে না পুলিশ। নিরুদ্দেশ হওয়ার আগে চাঁদরাতেও যশোরে গ্রামের বাড়িতে ফোন করেছিলেন ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন। রংপুর থেকে করা সেই ফোনের পর পরিবারের সঙ্গে আর যোগাযোগ করেননি তিনি।
গত ২৬ মে ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহাম্মদ আসসামস জগলুল হোসেন গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। ১৭ জুন পরোয়ানা তামিলসংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য তদন্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেয়া হয়।
যেভাবে নুসরাতের ভিডিও ভাইরাল হয়: পিবিআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মোয়াজ্জেম হোসেন ওসি হিসেবে রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থেকেও নিয়মবহির্ভূতভাবে নুসরাতের বক্তব্যের ভিডিও ধারণ ও প্রচার করে দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়েছেন।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের তিনটি ধারায় (২৬, ২৯ ও ৩১) ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে অপরাধের প্রমাণ পেয়েছে পিবিআই। তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ভিকটিম নুসরাতকে ওসির কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদের সময় তার দুই বান্ধবী নাসরিন সুলতানা, নিশাত সুলতানা এবং সোনাগাজী পৌরসভার মেয়র অ্যাডভোকেট রফিকুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।
ভিকটিমের পরিবারের সদস্যরা পাশের কক্ষে বসা ছিলেন। ভিকটিমের দুই বান্ধবীর বক্তব্য অনুযায়ী ভিডিও ধারণ করার পূর্বে ওসি মোয়াজ্জেম মুখের নেকাব খুলতে নুসরাতকে বাধ্য এবং দফায় দফায় বিব্রতকর প্রশ্ন করেন। আপত্তি জানালে ওসি তাকে আশ্বাস্ত করে বলেন, এই ভিডিওটি সম্পর্কে কেউ জানবে না। নিপীড়নের শিকার একজন ভিকটিমের সঙ্গে ওসির এ রকম অমানবিক আচরণ অপেশাদারিত্বের পরিচয় বহন করে।
ওসির এ পেশাগত অদক্ষ আচরণের ফলে নুসরাতকে আগুন দিয়ে হত্যার ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ এবং পুলিশের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ন হয়।
জিজ্ঞাসাবাদে সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম জানান, মোবাইলটি অফিসের টেবিলে রেখে অজু করতে যান। এ সময় তার অজ্ঞাতে একটি বেসরকারি টিভির ফেনী প্রতিনিধি (সাংবাদিক) শেয়ারইট অ্যাপসের মাধ্যমে নিজের মোবাইলে নিয়ে নেন।
কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তা তার প্রতিবেদনে বলেছেন, ওসির এ বক্তব্য বিশ্বাসযোগ্য নয়। ওসি নিজেই স্বেচ্ছায় তার ব্যক্তিগত মোবাইল থেকে ওই ভিডিও ক্লিপটি তার মোবাইলে পাঠায়। এ ছাড়া ওসির হোয়াটসঅ্যাপ আইডি থেকে অন্য একটি আইডিতেও ভিডিওটি পাঠানো হয়।