ভিজিএফ চাউল- বিতরন নাকি গলধঃকরণ
1 min readবাংলাদেশ সরকার দেশের উন্নয়নের লক্ষে বিভিন্ন সময়ে প্রকল্পের মাধ্যমে যে সকল উন্নয়ন মূলক কর্মকান্ড পরিচালনা করে থাকে তার মধ্যে অন্যতম একটি প্রকল্প “ভিজিএফ কর্মসূচি”। দুঃস্থদের খাদ্য সহায়তা প্রকল্প বা ভিজিএফ একটি অনিয়মিত খাদ্য সহায়তা কর্মসূচী। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারনে ক্ষতিগ্রস্থ ও অভাবগ্রস্থ পরিবারকে বিভিন্ন সময়ে ভিজিএফ কার্ডের মাধ্যমে সাময়িকভাবে খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়। এবার “ঈদ উল আযহা” উপলক্ষে দেশের সকল জেলার “দুঃস্থ ও অভাবগ্রস্থ পরিবার” এর মাঝে খাদ্য ও শষ্য সহায়তা কর্মসুচির আওতায় অন্যান্য স্থানের মতো ঝিনাইদহেও শুরু হয়েছে ভিজিএফ এর চাউল বিতরন।
ঝিনাইদহের ৬টি উপজেলার মোট ৬৭টি ইউনিয়ন চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে চলছে এ চাউল বিতরণ কর্মসুচির। তবে সরকারের অন্যান্য প্রকল্পের মতই এই “মানবিক সহায়তা কর্মসুচি” কে কেন্দ্র করে জন্ম নিচ্ছে দুর্নীতি, অনিয়ম, আত্মসাতের ঘটনা। বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে পাওয়া যাচ্ছে ভিজিএফ চাউল বিতরনের নামে হরিলুটের অভিযোগ। ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে ভুক্তভুগি দুঃস্থ ও অভাবগ্রস্থ পরিবারের লোকেদের ভিতর।
কালীচরণপুরঃ
গত ১৯ অগাস্ট রবিবার দুপুর নাগাদ অভিযোগ পাওয়া যায়, ঝিনাইদহ সদর উপজেলার ১৫নং কালীচরণপুর ইউনিয়নে পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে হতদরিদ্রদের মাঝে বিতরণকৃত চালে ওজনে কম দেওয়া হচ্ছে। সে সময় অভিযোগের সুত্র ধরে কালীচরণপুর ইউনিয়ন পরিষদে গেলে পাওয়া যায় ঘটনার সত্যতা।
এ সময় কথা হয় কালীচরণপুর ইউনিয়নের ভিজিএফ কার্ডধারী মান্দারবাড়ীয়া গ্রামের জাহাঙ্গীর আলম, কালীচরণপুর গ্রামের শিবু, উত্তর কাস্টসাগরা গ্রামের সামসুদ্দিন ও পয়মনা বেগমের সঙ্গে। তারা সবাই অভিযোগ করেন, সরকার আমাদের জন্য বরাদ্ধ করেছে ২০কেজি করে চাল। কিন্তু আমাদেরকে দেওয়া চাল ওজন করে পাওয়া যাচ্ছে সাড়ে ১৬কেজি থেকে ১৭কেজি। এ সময় সেখানে উপস্থিত থাকা অন্যান্য চাল গ্রহীতারাও বাজারের বিভিন্ন দোকানে ওজন করে চাল কম দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
তথ্যসুত্রে পাওয়া যায়, কারীচরণপুর ইউনিয়নের জন্য বরাদ্ধ চাউল ২৭,৮২০টন যা ১,৩৯১ জন হতদরিদ্রদের মাঝে ২০কেজি করে বিতরণ করার কথা। কিন্তু ২০কেজির পরিবর্তে মিলছে সাড়ে ১৬কেজি বা সাড়ে ১৭কেজি করে চাল বিতরণ করেছে যা প্রায় ২ থেকে ৩ কেজি কম।
এ বিষয়ে কালীচরণপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান কৃষ্ণপদ দত্ত জানান, চাল আমি ছুঁয়েও দেখিনা, সব পরিষদের সচিব জানে। এভাবে দেয়ার পর যে চাউল থাকে তা কার্ড বাদে যে সব মানুষ আসে তাদের দেয়া হয়। এ চাল আমি বাড়ী নিয়ে যায় না।
জানতে চাইলে ঝিনাইদহ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাম্মী ইসলাম বলেন, যদি ওজনে চাল কম দিয়ে থাকে তাহলে এটি ঠিক করেনি।
দোগাছিঃ
এরপর একই দিনে অর্থাৎ রবিবার দিবাগত রাতে সদর উপজেলায় দোগাছি ইউনিয়নে থেকে খবর পাওয়া যায় হরিলুটের। খবর পেয়ে উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় ক্যাম্পের পুলিশ অভিযান চালিয়ে আওয়ামীলীগ নেতার বাড়ি ও ৩টি প্রতিষ্ঠানের গোডাউন থেকে ১৬২ বস্তা সরকারী চাল জব্দ করে সিলগালা করে। চাউল বিতরণে এমন অনিয়ম ও আত্মসাতের ঘটনায় এলাকায় স্থানীয়দের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। আর গা ঢাকা দিয়েছে ঐ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ইছাহাক জোয়ার্দ্দার।
সরেজমিনে যেয়ে দেখা যায়, রবিবার রাতভর দারিদ্র মানুষের বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছে ঝিনাইদহের দোগাছি ইউনিয়ন। ঈদের আগে চেয়ারম্যানের মাধ্যমে চাউল বিতরণ করার কথা থাকলেও কার্ডধারী প্রায় ১২শ অভাবী পরিবারের বেশীরভাগই চাউল পায়নি। দুঃস্থদের পরিবর্তে এ চাল মিলেছে বিভিন্ন আওয়ামী লীগ নেতার ঘর, গোডাউন ও দোকানে। উদ্ধার করা হয়েছে ১৬২ বস্তা চাউল। ফলে বিক্ষোভে ফেঁটে পড়ে সে সকল পরিবারগুলো, রাস্তায় নেমে এসে করেছে বিক্ষোভ, মিছিল আর বিচার দাবি।
সদর উপজেলা সূত্রে জানা যায়, ঝিানইদহ জেলার ৬ টি উপজেলার ৬৭ টি ইউনিয়নে আসন্ন ঈদুল আজহা উপলক্ষে ১৫শত ৪৬ মেট্রিক টন চাল বিপদাপন্ন জনগোষ্টির খাদ্য ও শষ্য সহায়তা কর্মসুচির আওতায় ভিজিএফ চাল অন্যান্য স্থানের মতো বিতরন করার কথা। এ ইউনিয়নের ৯টি ওয়ার্ডে ১১শত ৯১টি কার্ডের মাধ্যমে ২৩.৮২ মেট্রিকটন চাল বিতরণ করার কথা ছিল।
মেম্বর মকবুল হোসেন বিশ্বাস জানান, চাল বিতরণের সময় সংশ্লিষ্ট সরকারী ট্যাগ অফিসার সহ অন্যান্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। ছিলেন না চেয়ারম্যানও। কলেমনখালী বাজার কমিটির সভাপতি ঠান্ডু মিয়া জানান, সরকারী চাউল হরিলুট করা হয়েছে বিভিন্ন নেতা আর প্রভাবশালীদের মাধ্যমে। কেউ কেউ ১টির পরিবর্তে ৩/৪টি কার্ডের চাউল পেয়ে তা বিক্রি করে দিয়েছে খোলা বাজারে, কেউ বা বস্তা বস্তা চাউল করেছে গুদামজাত।
চাউল বিতরণের সময়ে অনুপস্থিত থাকার কারন জানতে চাইলে দ্বায়ীত্বে থাকা সদর উপজেলা ট্যাগ অফিসার ও নির্বাচন কর্মকর্তা এনামুল হক জানান, আমাকে এ বিষয়ে কেউ কিছু জানায়নি।
নারকেলবাড়িয়া ক্যাম্প ইনচার্জ বদিউজ্জামান জানান, আত্মসাৎ মামলা হবে দোষীদের বিরুদ্ধে। সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাম্মি ইসলাম জানান, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তরাও ছিলেন না চাউল বিতরণের সময়। চাউল হরিলুটের এমন খবরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ছুটে যায় ঘটনাস্থলে । পুলিশ নিয়ে রাতভর অভিযান চালিয়ে সক্ষম হন বিপুল পরিমান উদ্ধার চাউল করতে ।
শিমলা-রোকনপুরঃ
ওজনে চাল কম দেয়ায় কালীগঞ্জ উপজেলার শিমলা-রোকনপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নাসির উদ্দীন চৌধুরীর গালে চড় বসিয়ে দিয়েছেন এক ভ্যানচালক। সোমবার দুপুরে উপজেলার ৫নং শিমলা রোকনপুর ইউনিয়ন পরিষদ চত্বরে এ ঘটনা ঘটেছে।
জানা যায়, ঈদ উপলক্ষে জনপ্রতি ২০ কেজি করে চাল দেয়ার কথা থাকলেও ওই ইউনিয়নে ১০ কেজি করে চাল বিতরণ করা হয়। দুপুরে চেয়ারম্যানের উপস্থিতিতে ভ্যানচালক শরিফুলকে ৭ কেজি চাল দেয় গ্রাম পুলিশ আব্দুল হাকিম। ওজনে কম দেয়ায় চাল নিতে অস্বীকৃতি জানায় শরিফুল। এ দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে চেয়ারম্যান ভ্যানচালকের মুখে চড় মেরে বের করে দেয়ার চেষ্টা করে। এসময় ভ্যানচালক শরিফুলও পাল্টা চড় বসিয়ে দেয় চেয়ারম্যানের মুখে।
চেয়ারম্যানকে চড় মারার পর সেখানে উপস্থিত গ্রাম পুলিশের সদস্যরা শরিফুলকে বেধড়ক মারপিট করে বের করে দেয়। ভ্যানচালক শরিফুল ইসলাম কালীগঞ্জ উপজেলার ছোটশিমলা গ্রামের ছবেদ আলী মণ্ডলের ছেলে। ঘটনার পর ভ্যানচালক শরিফুল ইসলাম কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ দেন।
এ ব্যাপারে চেয়ারম্যান নাসির উদ্দীন চৌধুরী জানান, শরিফুল ভিজিএফএর তালিকাভুক্ত না। গরিব হওয়ায় মানবিক কারণে তাকে ১০ কেজি চাল দেয়া হয়েছিল।
কালীগঞ্জঃ
ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে ৪৬ বস্তা ভিজিএফ’র চাল উদ্ধার করেছে পুলিশ। সোমবার বিকাল ৪টার দিকে কালীগঞ্জ শহরের নলডাঙ্গা সড়ক থেকে এই চাল উদ্ধার করা হয়। বিকালে ভিজিএফ এই চাল দু’টি ইঞ্জিন চালিত নসিমনে করে শহরের ভাদু চৌধরুরীর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বিক্রি করতে আনে। এসময় স্থানীয়রা টের পেয়ে পুলিশকে খবর দেয়। খবর পেয়ে পুলিশ চাল জব্দ করে।
সংবাদ পেয়ে ঘটনাস্থলে আসেন ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার, উপজেলা নির্বাহী অফিসার উত্তম কুমার রায়, কালীগঞ্জ থানার ওসি মিজানুর রহমান।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার ঘটনাস্থলে পৌছে আটক করা চাল ওজন করেন। আটক চালের ওজন দেড় টন বলে জানান এই কর্মকর্তা।
এদিকে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের শিডিউল অনুযায়ি জনপ্রতি ২০ কেজি করে দেওয়ার কথা থাকলেও উপজেলার ১১ ইউনিয়নে বেশিরভাগ ১০ কেজি করে দুস্থ্যদের মাঝে চাল বিতরণ করা হয়। উপজেলা প্রশাসন কোন ব্যবস্থা না নেওয়ায় এমনটি হয়েছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছে। ফলে দুস্থ্য গরিবদের মধ্যে চরম অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।