মহেশপুর এসিল্যান্ড অফিসের ৪১ লাখ টাকা গায়েব!
1 min readমহেশপুর এসিল্যান্ড অফিসের কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর জালিয়াতি করে ভূয়া বিল ভাউচারের মাধ্যমে ৪১ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে।
স্থানীয় হিসাবরক্ষন অফিসের সহায়তায় মহেশপুর এসি ল্যান্ড অফিসের নাজির কাম-ক্যাশিয়ার মহিউদ্দীন আহম্মেদ ২০১২ সালের ২৯ জুলাই থেকে ২০১৬ সালের ৬ এপ্রিল পর্যন্ত এই টাকা আত্মসাত করে নিয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠেছে। ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসকের গঠিত তদন্ত কমিটির এক প্রতিবেদনে জালিয়াতির মাধ্যমে সরকারি অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার চাঞ্চল্যকর এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।
মহেশপুরের এসিল্যান্ড চৌধুরী রওশন ইসলাম শীর্ষ নিউজকে জানান, গত ২ মে মহেশপুর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিসের সাবেক নাজির জাল স্বাক্ষর করে সরকারের বিভিন্ন খাতের ২২ লাখ টাকা উত্তোলনের সময় হাতে নাতে ধরা পড়েন। এ ঘটনায় মামলা দায়েরের পর তাকে জেল হাজতে পাঠানো হয়। এ সময় তার কাছ থেকে ৮টি নকল সিল উদ্ধার করা হয়। ঘটনা তদন্তে ঝিনাইদহের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) খলিল আহম্মেদকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের এক কমিটি গঠিত হয়। ওই কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন, মহেশপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার আশাফুর রহমান ও ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসক অফিসের সহকারী কমিশনার তাছলিমা আক্তার।
জানা গেছে, গত ১৩ মে থেকে তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেন। ১৫ দিন তদন্ত শেষে গত ২৭ মে জেলা প্রশাসকের দপ্তরে তদন্ত কমিটি যৌথ সাক্ষরে তাদের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন। যার স্মারক নং জেপ্রঝি/০৩-০৬/১৬-৩৭। চার পৃষ্ঠার ওই তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, দুর্নীতির দায়ে অপসারিত ও আদালত কর্তৃক সাজাপ্রাপ্ত মহেশপুর এসি ল্যান্ড অফিসের নাজির কাম ক্যাশিয়ার মহিউদ্দীন আহম্মেদ ৪৬ মাসে ৬০টি বিলের মাধ্যমে ৪১ লাখ ১৬৬৭ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। ২০১৬ সালের ৬ এপ্রিল ১২৯ নং বিলের বিপরীতে মহিউদ্দীন টাকা তুলে নেন। তাকে সহায়তা করেন মহেশপুর উপজেলা হিসাব রক্ষন অফিসের দুর্নীতিবাজ কিছু কর্মকর্তা। তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে মহেশপুর উপজেলা হিসাব রক্ষন অফিসের টোকেন রেজিষ্টারের ৪৬৩৩ ও ৪৬৩৪ নং কোডে এমন কিছু বিলের সন্ধান পাওয়া গেছে যা উপজেলা ভুমি অফিস থেকে পাঠানো হয়নি। এমন অনেক বিল সাক্ষর জাল করে তুলে নেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে হিসাবরক্ষন অফিস কোন যাচাই বাছাই করেনি।
সুত্র জানায়, আত্মসাৎকৃত অর্থের পরিমাণ আরো বাড়তে পারে। কারণ মহেশপুর উপজেলা হিসাবরক্ষন অফিস তদন্ত কাজে দায়িত্বশীলতার সাথে সহায়তা করেনি। অনেক বিলের নথি তারা অফিস থেকে গায়েব করে দিয়েছেন। তদন্ত করার সময় সে সব বিল তারা দেখাতে পারেনি। ধারণা করা হচ্ছে, মহেশপুর উপজেলা হিসাব রক্ষন কর্মকর্তা সুজিত কুমার, অডিটর আব্দুল খালেক ও জুনিয়র অডিটর মোহাম্মদ আলী এই চক্রের সাথে জড়িত। জুনিয়র অডিটর মোহাম্মদ আলী বিভিন্ন সময় মহিউদ্দীনের কাছ থেকে ফ্রিজসহ নানা রকমের উপঢৌকন নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
আর তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হিসাব রক্ষন কর্মকর্তা সরকারী অর্থের আমানতকারী। প্রতিটি খাতেই সরকারী বরাদ্দ সুনিদ্দিষ্ট। কেউ ইচ্ছা করলেই বেশি টাকা তুলতে পারে না। কিন্তু জলিয়াতি চক্রের প্রধান মহিউদ্দীন কি ভাবে বিনা বাধায় বরাদ্দের অতিরিক্ত টাকা উত্তোলন করেছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তদন্ত কমিটি। তদন্ত কমিটির ভাষ্য প্রতি বছর হিসাব রক্ষন অফিসে আভ্যন্তরীন অডিট হয়।
প্রত্যেক ডিডিও যোগদান করার পর তাদের নমুনা সাক্ষর হিসাব রক্ষন কর্মকর্তার কাছে প্রেরণ করেন। এক্ষেত্রে আভ্যন্তরীন অডিট যেমন প্রশ্নবিদ্ধ, তেমনি সাক্ষর যাচাই না করে কি ভাবে একজন বরখাস্তকৃত ক্যাশিয়ারের কাছে হিসাবরক্ষন অফিস টাকা দিতেন এমন প্রশ্ন তোলা হয়েছে।
তদন্ত কমিটির এক কর্তকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্থে জানান, মহেশপুর এসিল্যন্ড অফিসের প্রধান সহকারী মোঃ খায়রুল ইসলাম এসিল্যান্ডকে না জানিয়ে বরখাস্তকৃত নাজির মহিউদ্দীনকে দিয়ে বিল করাতেন। এই বিলগুলো অফিস থেকে যাওয়ার মাঝ পথেই পরিবর্তন করতো মহিউদ্দীন। সেখানে এসিল্যন্ডসহ প্রত্যেকের জাল সাক্ষর করে নকল সিল মোহর ব্যবহার করা হতো। তবে এ সব বিলে প্রধান সহকারী মোঃ খায়রুল ইসলামের অনুসাক্ষর নেই। এ সব বিলে এ্যামবুশ সিল ব্যবহার করা হয়েছে। এতেই প্রমানিত হয় মহিউদ্দীনের সাথে মহেশপুর হিসাব রক্ষন অফিসের কর্মকর্তারা জড়িত।
এ বিষয়ে মহেশপুর উপজেলা হিসাব রক্ষন কর্মকর্তা সুজিত কুমার জানান, এই জালিয়াতি ঘটনার সাথে তারা জড়িত নয়। তিনি বিলেন ২০১২ সাল থেকে এ পর্যন্ত অনেক এসিল্যান্ড, অডিটর ও হিসাবরক্ষন কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করেছেন। আমি বেশি দিন এখানে আসেনি।
তিনি পাল্টা অভিযোগ করে বলেন, এসিল্যান্ড অফিস একজন বরখাস্তকৃত নাজির দিয়ে বিল ওঠানোর দায়িত্ব দিয়ে ভুল করেছেন। এর দায়ভার তোর আমরা নেব না। তবে তিনি বিল গয়েব করার বিষয়টি এড়িয়ে যান। তিনি উপরের নির্দেশ ছাড়া আমি এ সব বিল দেখাতে পারি না। তদন্ত কমিটির প্রধান ঝিনাইদহের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) খলিল আহম্মেদ বলেন, আমরা একটি তদন্ত রিপোর্ট জমা দিয়েছি। সেখানে ৪১ লাখের কিছু বেশি টাকার গরমিল পাওয়া গেছে বলে জানান তিনি। আর তদন্ত এখনো চলমান রয়েছে। মহেশপুর হিসাব রক্ষন অফিস যে ভাবে সহায়তা করার কথা সেভাবে করেনি। তারপরও আমরা আরো অনুসন্ধান চালাচ্ছি।
সূত্রে জানা গেছে, জালিয়াতি চক্রের প্রধান মহিউদ্দীন কোটচাঁদপুর ইউএনও অফিসে চাকরী করার সময় জালিয়াতির দায়ে জিআর ২১/৯২ নং মামলায় ১০ বছর সাজাপ্রাপ্ত হন। দীর্ঘদিন কারাভোগের পর সুপ্রিম কোর্টের ক্রিমিনাল আপীলের ১১৩৬/৯৯ নং মামলার রায়ে তিনি খালাস পেয়ে পুনরায় চাকরীতে যোগদান করেন। এরপর ২০১৫ সালের ১৩ অক্টোবর কালীগঞ্জ উপজেলা ভুমি অফিসের ১০ লাখ টাকা দুর্নীতির মাধ্যমে উত্তোলনের দায়ে অপসারিত হন।