প্রভাত কুমার থেকে যেভাবে জঙ্গি আবদুল্লাহ
1 min readঝিনাইদহের সনাতন হিন্দু পরিবারের প্রভাত কুমার বাউতি এখন জঙ্গি আবদুল্লাহ। অভাবী হিন্দু পরিবারের সাধারণ অশিক্ষিত শ্রমিক থেকে সে বোমা, গ্রেনেড মেরে মানুষ মারার প্রশিক্ষণ নিয়ে দুর্ধর্ষ জঙ্গিতে পরিণত হয়েছে সে। মানুষ মারতে গিয়ে নিজের মৃত্যুতেও তার ভয় নেই। এজন্য নিজ বাড়িতেই গড়ে তুলেছিলেন অস্ত্রের কারখানা। বোমা, গ্রেনেড এবং সুইসাইডাল ভেস্ট নিয়ে অবস্থান করতেন। বোমা তৈরির সরঞ্জাম ছিল তার। বর্তমানে পলাতক জঙ্গি আবদুল্লাহকে ধরতে অভিযান অব্যাহত রেখেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গত শুক্রবার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে পোড়াহাটি গ্রামের ঠনঠনেপাড়ায় আবদুল্লাহর বাড়িটি ঘিরে রাখে। রাত সাড়ে ১০টার দিকে পুলিশের খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি দিদার আহম্মেদ রাতের জন্য অভিযান স্থগিত ঘোষণা করেন। পরদিন সকাল সোয়া ৯টা থেকে কাউন্টার টেরোরিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি), র্যাব, পুলিশ, পিবিআই, এলআইসি, বোমা ডিসপোজাল ইউনিট, খুলনা রেঞ্জ পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অপারেশন ‘সাউথ প’ (দক্ষিণে থাবা) নামে অভিযান চালিয়ে তার বাড়ি থেকে ২০ ড্রাম হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, ১০০ প্যাকেট লোহার বল, ৩টি সুইসাইডাল ভেস্ট, ৯টি সুইসাইডাল বেল্ট, বিপুল পরিমাণ ইলেকট্রিক সার্কিট, ১৫টি জিহাদি বই, ১টি বিদেশি পিস্তল, ১টি ম্যাগাজিন, ৭ রাউন্ড গুলি, ১টি মোটরসাইকেল, ১টি চাপাতি, বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক, ৬টি শক্তিশালী বোমা উদ্ধার করে। এর মধ্যে ৩টি সুইসাইডাল ভেস্ট ও ২টি বোমা নিষ্ক্রিয় করা হয়।
অভিযানের আগেই পালিয়ে যায় জঙ্গি আবদুল্লাহ। পুলিশ বাড়িটি ঘিরে ফেলার আগেই সে পরিবারসহ পালিয়ে যায়। এরপরই প্রভাত কুমার বাউতির ধর্মান্তরিত হয়ে আবদুল্লাহ হয়ে উঠার কাহিনী নিয়ে এলাকায় নানা কাহিনী ছড়িয়ে পড়ে। অভাবী পরিবারে লেখাপড়াও তেমন করেনি সে। কিশোর বয়সেই কাজে যোগ দিয়েছে। গ্রামে দিনমজুরের কাজ করেছে। এরপর তেলের পাম্পে শ্রমিকের চাকরি করেছে ১৫ বছর। এর মধ্যে দুটি বিয়ে করে। প্রথম স্ত্রীর ঘরে তার একটি মেয়ে রয়েছে। এরপর স্ত্রীর সঙ্গে তার ছাড়াছাড়ি হয়। পরে প্রেম করে বিয়ে করেন মেঝ ভাই বিপুল বিশ্বাসের শ্যালিকাকে। সেই ঘরে দুটি ছেলে সন্তান হয়। পরে তার সঙ্গেও ছাড়াছাড়ি হয়।
দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পর পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে প্রভাত কুমারের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। বছর পাঁচেক আগে ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে প্রভাত কুমার। নতুন নামকরণ হয় আবদুল্লাহ। আর ধর্মান্তরিত হওয়ার দায়ে তার দুই ভাই তাকে বাড়িছাড়া করেন। তখনই জানা যায়, ধর্মান্তরিত হওয়ার আগেই সে এক মুসলমান মেয়েকে বিয়ে করেছে।
এলাকাবাসী জানায়, ঝিনাইদহ সদর উপজেলার চুয়াডাঙ্গা গ্রামের আবদুল লতিফের মেয়ে ফাতেমা ওরফে রুবিনাকে বিয়ে করে আবদুল্লাহ। এ ঘরে তার আয়েশা (২) নামের একটি কন্যা সন্তান রয়েছে। বিয়ের পর ঠনঠনেপাড়ায় জমি কিনে বসবাস শুরু করে সে। তবে ওই পাড়ার অন্য মুসলমান কিংবা সাধারণ প্রতিবেশীদের সঙ্গে তার কোন যোগাযোগ ছিল না। সব সময় প্রতিবেশীদের সে এড়িয়ে চলত। মোটামুটি বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন করত সে। তার স্ত্রী রুবিনাও প্রতিবেশীদের সঙ্গে মিশতো না। আলমসাধু (স্যালো ইঞ্জিনচালিত যান) চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করত সে। প্রতিবেশীদেরও তাকে নিয়ে তেমন আগ্রহ ছিল না।
প্রতিবেশী আসলাম, ইউসুফ আলী ও চাঁদ আলী জানান, বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়ার পর আবদুল্লাহ পোড়াহাটির ঠনঠনেপাড়ায় ওয়াহেদ নামের একজনের কাছ থেকে ৬০ হাজার টাকায় মাঠের মধ্যে এই জমি কেনেন। সেখানে একটি দুই রুমের টিনশেড বাড়ি তৈরি করে বসবাস করতে শুরু করেন। প্রতিবেশীরা দাবি করেন, আবদুল্লাহ’র বাড়িতে কেউ যেত না। মাঝে মধ্যে মোটরসাইকেলে অচেনা কিছু লোক তার বাড়িতে যাওয়া-আসা করত। বাড়িটি টিন দিয়ে চারিদিক থেকে ঘেরা ছিল। বাইরে থেকে কিছুই দেখা যেত না। বাড়িতে থাকলেও কেউ ডাকলে আবদুল্লাহ সাড়া দিত না। সে সবার থেকে আলাদা ও বিচ্ছিন্নভাবে চলাফেরা করত।
প্রতিবেশী শিরিনা খাতুন বলেন, আবদুল্লাহর স্ত্রী ফাতেমা ওরফে রুবিনা কারও সঙ্গেই কথা বলত না। সবসময় মুখ কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখত। তার স্ত্রীকে কেউ দেখতে পারত না। সব সময় বাড়ির গেট তালা লাগিয়ে রাখত।
একই গ্রামের টিপু জোয়ার্দ্দার জানান, ধর্মান্তরিত হওয়ার আগে আবদুল্লাহ পোড়াহাটির শরিফুল ইসলামের তেল পাম্পে ১৪/১৫ বছর শ্রমিকের কাজ করেছে। বর্তমানে সে আলমসাধু গাড়ি চালাত। আলমসাধুতে সে কাঠের গুঁড়ি নিয়ে বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দিত। মাঝে মধ্যে মোটরসাইকেলে ঘুরত। বিভিন্ন সময় তার সঙ্গে মোটরসাইকেলে অপরিচিত লোকদের আসতে দেখা যেত।
জামিরুল ইসলাম নামে গ্রামের আরেক ব্যক্তি জানান, আবদুল্লাহ গ্রামের মসজিদে নামাজ পড়ত না। গ্রামের মসজিদে নাকি তার নামাজ হবে না এই কথা বলত। তাই সে শহরের মারকাজ মসজিদে নামাজ পড়তে যেত। গ্রামের কোনো লোকের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল এমন আমরা দেখিনি। তবে আবদুল্লাহ জঙ্গি হতে পারেন এই কথা জানার পর গ্রামের লোকজন বিস্ময়ও প্রকাশ করেছেন। আসলেই দোষী হলে তাকে গ্রেপ্তার করা উচিত বলে মনে করেন তারা।
পুলিশের খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি দিদার আহমেদ জানান, বাড়িটিকে জঙ্গিদের বোমা তৈরির কারখানা বলা যেতে পারে। এই বাড়িতে তিন-চার জন জঙ্গি ছিল। তারা আগেই পালিয়ে গেছে। এই জঙ্গিদের সবাই জেএমবি ও নব্য জেএমবির সদস্য। এই বাড়িতে জঙ্গি সংগঠনগুলোর বিভাগীয় পর্যায়ের লোকজন আসা-যাওয়া করত।
পোড়াহাটি থেকে আবদুল্লাহ’র শাশুড়ি আটক : ঝিনাইদহে পোড়াহাটি গ্রাম থেকে সেই জেএমবি আবদুল্লাহ’র শাশুড়ি মাজেদা খাতুন নামের এক নারী নব্য জেএমবি সদস্যকে আটক করেছে পুলিশ। গত শনিবার রাতে সদর উপজেলার পোড়াহাটি গ্রাম থেকে তাকে আটক করা হয়।
ঝিনাইদহ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হরেন্দ্রনাথ সরকার জানান, জেএমবি মাজেদা খাতুনকে আটক করা হয়েছে। ঝিনাইদহ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজবাহার আলী শেখ জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তারা জানতে পারে নব্য জেএমবি আবদুল্লাহর শাশুড়ি জেএমবি সদস্য মাজেদা খাতুন নিজ বাড়িতে অবস্থান করছে। এমন খবরের ভিত্তিতে সেখানে অভিযান চালিয়ে তাকে আটক করা হয়। মাজেদা খাতুন তার জামাতা নও মুসলিম আবদুল্লাহর দলের সক্রিয় সদস্য বলে জানান পুলিশ।
উল্লেখ্য, গত শনিবার নব্য জেএমবি আবদুল্লাহর বাড়িতে ‘অপারেশন সাউফ-প’ পরিচালনা করে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। সেখান থেকে উদ্ধার করা হয় বিপুল পরিমাণ বোমা তৈরির সরঞ্জাম, পিস্তল, জিহাদি বই এবং রাসায়নিক সরঞ্জামাদি।